নাহিদ ইসলামের ফেসবুক পোস্ট ঘিরে নতুন করে বিতর্ক, রাজনীতিতে আলোচন

নাহিদ ইসলামের ফেসবুক পোস্ট ঘিরে নতুন করে বিতর্ক, রাজনীতিতে আলোচন

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের একটি প্রচেষ্টা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা ছিল। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের একটি ফেসবুক পোস্ট সেই বিষয়টিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে নাহিদ ইসলাম একটি পোস্টে লেখেন, “বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে জাতীয় সরকারের প্রস্তাবনা ছাত্রদের পক্ষ থেকে আসেনি। এই বক্তব্যটি সত্য নয়।” তিনি জানান, ৫ আগস্ট রাতের প্রেস ব্রিফিংয়ের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে তাদের একটি ভার্চুয়াল মিটিং হয়, যেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জাতীয় সরকার ও নতুন সংবিধানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তারেক রহমান সেই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে নাগরিক সমাজের সদস্যদের দিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরামর্শ দেন এবং তারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রস্তাব করেন। নাহিদ আরও উল্লেখ করেন যে ৭ আগস্ট মির্জা ফখরুলের বাসায় তাদের অন্তর্বর্তী সরকার ও উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে আলোচনা হয়।
এই মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যম-কে বলেন, “নাহিদ ইসলামের দাবি সঠিক নয়। জাতীয় সরকারের ব্যাপারে আমাদের দলের পক্ষ থেকে কোনো কথা বলা হয়নি। তারেক রহমানের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে কিনা, সেটা আমাদের জানা নেই।”
নাহিদ তার পোস্টে যে সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করেছেন, সেটি গত ২৬ জুলাই ইনতেশর২৪-এ প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, “(বৈষম্যবিরোধী) ছাত্রনেতাদের সঙ্গে ৫ আগস্টের পর আমাদের কোনো দেখা হয়নি। জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব ছাত্রদের কাছ থেকে নয়, অন্য কোনো মহল থেকে আসতে পারে।”
উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থানে তৎকালীন সরকার পতন হয়। ওই রাতে নাহিদ ইসলামসহ ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বেসরকারি টেলিভিশন ‘চ্যানেল ২৪’-এর মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য দেন, যা নাহিদ ‘প্রেস ব্রিফিং’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

শিবির নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তার ফেসবুক পোস্টে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা মো. আবু সাদিক কায়েমেরও সমালোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “শিবির নেতা সাদিক কায়েম সম্প্রতি একটি টক শোতে বলেছেন যে ছাত্রশক্তির গঠন প্রক্রিয়ায় শিবির যুক্ত ছিল এবং শিবিরের নির্দেশনায় তারা কাজ করত। এটা মিথ্যাচার।”
নাহিদের ভাষ্যমতে, ‘গুরুবার আড্ডা’ পাঠচক্রের কিছু সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে পদত্যাগ করা কিছু সদস্য এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্টাডি সার্কেল মিলে ছাত্রশক্তি গঠিত হয়। তিনি আরও বলেন, “আমরা সব পক্ষের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতাম, যার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। কিন্তু যোগাযোগ মানে এই নয় যে তারা আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল।”
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অধিকাংশ সমন্বয়ক ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ নামক একটি সংগঠনের নেতা ছিলেন। নাহিদ ছিলেন সেই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব।
নাহিদ তার পোস্টে দাবি করেন, সাদিক কায়েম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিলেন না, কিন্তু ৫ আগস্ট থেকে তিনি এই পরিচয় ব্যবহার করেন। অভ্যুত্থানে শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে সাদিক কায়েমকে সংবাদ সম্মেলনে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সাদিক কায়েম পরে প্রচার করেছেন যে এই অভ্যুত্থানে শিবির নেতৃত্ব দিয়েছে। নাহিদ স্পষ্ট করে বলেন যে অভ্যুত্থান শিবিরের একক নয় এবং তাদের নির্দেশনায়ও হয়নি।
নাহিদের এসব মন্তব্যের জবাবে শিবির নেতা সাদিক কায়েম ইনতেশর২৪-কে বলেন, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি নীতিনির্ধারণ ও মাঠপর্যায়ের সমন্বয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হতো।” সাদিক কায়েম মনে করেন, নাহিদ এমন কথা বলে নিজেরই ক্ষতি করছেন।

২ আগস্ট রাতে চাপ সৃষ্টির অভিযোগ
নাহিদ তার পোস্টে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ের একটি নতুন বিষয় সামনে এনেছেন। তিনি লিখেছেন, “২ আগস্ট রাতে প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েররা সামরিক বাহিনীর একটি অংশের হাতে ক্ষমতা দিতে চেয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে কথিত সেইফ হাউসে থাকা ছাত্র সমন্বয়কদের চাপ ও হুমকি দেওয়া হয়, যাতে তারা ওই রাতে ফেসবুকে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করে এবং আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে।”
নাহিদ আরও লেখেন, তাদের অবস্থান ছিল স্পষ্ট: ক্ষমতা কোনোভাবে সেনাবাহিনী বা সেনাবাহিনী-সমর্থিত কোনো পক্ষের হাতে দেওয়া যাবে না, কারণ এতে আরেকটি ‘এক-এগারো’ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাই এই অভ্যুত্থানকে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থান হিসেবে সফল করতে তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
নাহিদের অভিযোগ, ৫ আগস্টের পর থেকে জুলকারনাইন সায়েররা বারবার তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা নেতৃত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন এবং সাদিক কায়েমদের এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি আরও অভিযোগ করেন যে কলরেকর্ড ফাঁস, নজরদারি, অপপ্রচার, প্রোপাগান্ডাসহ নানা কাজ চলছে।
নাহিদের এই অভিযোগের বিষয়ে জুলকারনাইন সায়ের গণমাধ্যম-কে বলেন, “এই অভিযোগ শোনা হাস্যকর। এটি শুধু মিথ্যা ও ভিত্তিহীনই নয়, বরং মূলধারার গণমাধ্যমে তাদের প্রকাশিত অপকর্মগুলো থেকে জনদৃষ্টি সরানোর একটি সস্তা চেষ্টা।”
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বার্ষিকী পালনের এই সময়ে নাহিদ ইসলামের এই পোস্ট রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus ( )