পদ্মার চরাঞ্চল সীমান্ত যেন ‘মৃত্যু উপত্যকা’

পদ্মার চরাঞ্চল সীমান্ত যেন ‘মৃত্যু উপত্যকা’

লোভে সীমান্ত অতিক্রম করে নদীপথে গরু-মহিষ আনতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য বাংলাদেশি যুবক। বর্ষাকালে পদ্মায় সাঁতরে চোরাইপথে গরু আনার সময় বিএসএফের গুলিতে ও নির্যাতনে প্রাণ যাচ্ছে রাখালদের। পদ্মায় গরু ভাসিয়ে আনার সময় ধরা পড়ে অনেকেই আর ঘরে ফিরতে পারে না। যারা ফেরে, তারা কপালগুণে বেঁচে যায়। তবে বেশিরভাগই হয়ে পড়ে নিখোঁজ কিংবা লাশ হয়ে ফেরে।

স্থানীয়দের মতে, দেশের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্তগুলোর একটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা তীরবর্তী ২৫ কিলোমিটার চরাঞ্চল। বিএসএফের হাতে নিয়মিত হত্যাকাণ্ড ঘটছে এখানে। অনেক সময় লাশ ফেরত দেওয়া হলেও, বেশিরভাগ সময় তা ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে অথবা গোপনে ডুবিয়ে রাখা হয়।

এই সীমান্তজুড়ে প্রাণঘাতী এই খেলার শুরু হয়েছিল কয়েক বছর আগে। এক সময় সীমান্তে করিডর ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারত থেকে গরু-মহিষ বৈধভাবে আমদানির সুযোগ ছিল। তবে ২০১৮ সালের পর করিডর বাতিল হওয়ায় চোরাপথে গরু আনার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে বাড়ে হতাহতের সংখ্যাও।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গরু ও মাদকপাচার সিন্ডিকেটগুলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় সক্রিয়। এরা কিশোর ও যুবকদের বিপুল টাকায় চুক্তিতে নিয়োগ দেয়। গরু আনতে পারলে দেওয়া হয় ৩০–৪০ হাজার টাকা, আর মাদক আনতে পারলে ২০–২৫ হাজার টাকা। রাতের আঁধারে তারা পদ্মার মাঝখানে নৌকায় অপেক্ষা করে, আর সংকেত পেলে গরু ও রাখাল নিয়ে কূলে উঠে পড়ে।

গরু পাচারের এক সদস্য জানান, ভারতে এক জোড়া গরুর দাম পড়ে ৪০–৫০ হাজার টাকা। তা ভাসিয়ে এনে বাংলাদেশে বিক্রি করলে মুনাফা দাঁড়ায় গরুপ্রতি ৮০–৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

পদ্মার চরাঞ্চল বর্ষাকালে প্রায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়। এ অঞ্চলের প্রায় ২৫টি চরগ্রামে লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে। এদের অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পার হয় ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় পৌঁছাতে। সেখান থেকে গরু নিয়ে ফারাক্কার নিকটবর্তী ধুলিয়ান ঘাটে এসে রাতের অন্ধকারে পদ্মায় ঝাঁপ দেয়। তীব্র স্রোতে ৩০–৪৫ মিনিটে বাংলাদেশে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। কিন্তু মাঝপথেই অনেকে বিএসএফের হাতে ধরা পড়ে নির্মমভাবে নিহত হয়।

একাধিক জনপ্রতিনিধির দাবি, ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফের হাতে দুই শতাধিক বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। এদের অনেকেরই কোনো রেকর্ড নেই। সাম্প্রতিক একটি ঘটনায়, ২৮ জুলাই গরু আনতে গিয়ে বিএসএফের হাতে ধরা পড়ে সৈবুর রহমান (২৮)। পরে তার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায় পদ্মা নদীতে। একইভাবে নিখোঁজ হয় বেনজির আলী (২৬), নিহত হয় লাল চাঁন মিয়া (৩০) ও আরও অনেকে। বেশিরভাগ সময় এসব লাশ গোপনে দাফন করা হয়, কোনো আইনি রেকর্ড থাকে না।

স্থানীয়রা মনে করেন, সীমান্তের ভয়াবহ এই পরিস্থিতির জন্য মূলত সচেতনতার অভাব এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দুর্বলতা দায়ী। সীমান্তে থাকা বিজিবির পাঁচটি ফাঁড়ি পুরো পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না।

বিজিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, এই চরাঞ্চল অত্যন্ত দুর্গম এবং মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সবসময় নজরদারি সম্ভব হয় না। বর্ষাকালে সীমান্ত এলাকার চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। কেউ আহত বা নিহত হলে পরিবার বা স্থানীয়রা তথ্য দেয় না বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তবে সীমান্তে নজরদারি ও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি সবসময় সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বলেও তিনি জানান।

Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus ( )